নিয়মিত গ্রিন টি পান করার উপকারিতা

 ভূমিকা 

আজকাল স্বাস্থ্য সচেতন নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত, স্বাস্থ্য সচেতনের কথা মনে রেখে যে পানীয় টি পান করি, তা হলো গ্রিন টি। এটি অন্য চায়ের মত নয়, বরং এটি হলো প্রকৃতির দেওয়া এক অসাধারণ ওষুধি উপাদান। আমরা গ্রিন টি সাথে মোটামোটি সকলেই পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে বাংলাদেশও চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিন টি হচ্ছে প্রশান্তি দায়ক পানীয় যার মধ্যে রয়েছে প্রচুর স্বাস্থ্যকর কার্যকরী উপকারিতা।   
চা পাতাকে সামান্য প্রক্রিয়াজাত করে বানানো এই পানীয়তে রয়েছে এমন সব পুষ্টি উপাদান, যেগুলো মানব দেহে নিয়মিত সেবন করলে আপনার শরীর থেকে টক্সিন বের করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং এমনকি ওজন কমাতেও সাহায্য করে। চলুন জেনে নিই, নিয়মিত গ্রিন টি পান করার উপকারিতা কী কী এবং কেন এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হওয়া উচিত।   

গ্রিন টি কী এবং কেন এটি এত উপকারী?

গ্রিন টি হলো অপরিশোধিত চা পাতা থেকে তৈরি এক  ধরনের চা, যেখানে রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পুষ্টিগুণ অক্ষত থাকে। এতে ক্যাফেইন তুলনামূলক ভাবে কম থাকায় শরীর ও মন ঠিক থাকে। এটি হজম শক্তি বাড়ায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হ্রদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে ভূমিকা রাখে। তাই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের কাছে গ্রিন টি আজ এত  বেশি জনপ্রিয়।  

গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে, যারা প্রতিদিন অন্তত ২ কাপ গ্রিন টি পান করবে, তাদের হ্রদরোগের ঝুঁকি ২৫% কমে যায়। একই সাথে ওজন নিয়ন্ত্রণ থাকে, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ত্বকের সৌন্দর্যেও এতিবাচক প্রভাব ফেলে।  

নিয়মিত গ্রিন টি পান করার ১০ টি অবিশ্বাস্য উপকারিতা  

১। হ্রদরোগের ঝুঁকি কমায়ঃ
গ্রিন টিতে থাকা ক্যাটেচিন নামক  দেহে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তের কোলেস্টেরল ও ক্ষতিকর ফ্যাট  কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখে, ফলে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে। এসব কারণে হ্রদরোগের ঝুঁকি কমে এবং হৃৎপিণ্ড সুষ্ট রাখতে গ্রিন টি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। 

২। ওজন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকাঃ
নিয়মিত গ্রিন টি পান করায় প্রাকৃতিক ক্যাটেচিন ও ক্যাফেইন শরীরের বিপাকক্রিয়া (Metabolism) বাড়ায়, যা অতিরিক্ত ক্যালরি কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে দেহের ফ্যাট অক্সিডেশন বা চর্বি ভাঙার প্রক্রিয়া দ্রুত হয়, যার কারণে ওজন নিয়ন্ত্রণ খুব সহজ হয়। পাশাপাশি এটি ক্ষুধা কিছুটা কমায়, যা অতিরিক্ত খাবার প্রবণতা হ্রাস করে। তাই স্বাস্থ্যকর ডায়েট ও সঠিক ব্যায়ামের সাথে গ্রিন টি ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।     

৩। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়কঃ
গ্রিন টিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিশেষ করে পলিফেনল এবং ক্যাটেচিন রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে গ্লুকোজকে কোষে গ্রহণ সহজ করে তোলে, ফলে দেহের রক্তে অতিরিক্ত শর্করা জমাতে পারে না। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে টাইপ- ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও এটি  বেশ উপকারী।   
৪। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়ঃ
নিয়মিত গ্রিন টি পান করায় এতে থাকা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন- ক্যাটেচিন ও পলিফেনল শরীরে ফ্রি-র‍্যাডিক্যাল নামক ক্ষতিকর  উপাদানকে দমনে ভূমিকা রাখে। এই ফ্রি-র‍্যাডিক্যাল কোষের ডিএনএ নষ্ট করে ক্যান্সারের ঝুঁকি  বাড়ায়। গ্রিন টি কোষের সুরক্ষা দেয়, অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিতে বাঁধা প্রদান করে এবং  ক্যান্সার সৃষ্টির প্রক্রিয়া প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। তাই নিয়মিত গ্রিন টি পান করে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক কাজ করে।    

৫। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়ঃ
গ্রিন টিতে থাকা ক্যাফেইন ও অ্যামিনো অ্যাসিড এল-থিয়ানিন মস্তিষ্ককে সক্রিয় ও সতেজ রাখতে সাহায্য করে। ক্যাফেইন মনোযোগ, স্মরণশক্তি ও সজাগ ভাব বৃদ্ধি করে, আর এল-থিয়ানিন মানসিক চাপ কমিয়ে মনকে শান্ত ও শক্তিশালী রাখে। এ দু'টির সমন্বয়ে গ্রিন টি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা খুবই উন্নত করে, চিন্তাশক্তি বাড়ায় এবং ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে।   

৬। মানসিক ভারসাম্য রক্ষাঃ
নিয়মিত গ্রিন টি পান করায় এতে থাকা এল-থিয়ানিন নামক অ্যামিনো অ্যাসিড স্নায়ুকে শিথিল করে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মনকে প্রশান্ত রাখে। ফলে উদ্বেগ, দুশ্চিতা ও অস্থিরতা কমে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে মন সতেজ ও ইতিবাচক থাকে। 

৭। রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ 
মানব দেহের রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গ্রিন টি বিশেষ কার্যকরী উপাদন। গ্রিন টিতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিশেষ করে ক্যাটেচিন ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়। গ্রিন টি ত্বকের ভেতর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে সানবার্ন, লালচে ভাব ও অকাল বার্ধক্য দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে ত্বককে ভেতর থেকে মজবুত  ও শক্ত করে তোলে এবং বাইরের ক্ষতির রশ্মি থেকে রক্ষা করে।   

৮। ত্বকের সৌন্দর্য ও বার্ধক্য রোধঃ
নিয়মিত গ্রিন টি পান করায় এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন ত্বককে ভেতর থেকে পুষ্টি জোগায় এবং পাশাপাশি ক্ষতিকর ফ্রি-র‍্যাডিক্যালের নষ্ট হওয়া কমায়, ফলে দেহের বলিরেখা ও ঝুলে যাওয়া দেরিতে হয়। পাশাপাশি গ্রিন টি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, দাগ-ছোপ হ্রাস করে এবং দীর্ঘদিন ত্বককে তরুণ ভাব বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত গ্রিন টি পান করার মাধ্যমে ত্বকের সৌন্দর্য ও বার্ধক্য রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।   

৯। মুখ ও দাঁতের যত্নের সহায়কঃ
গ্রিন টিতে থাকা ক্যাটেচিন মানব দেহের মুখে ক্ষতিকর জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সহায়তা করে, যা দাঁতের ক্ষয় ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি মুখের দুর্গন্ধ কমায় এবং দাঁতকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং প্রাকৃতিকভাবে দাঁতের যত্ন নিশ্চিত হয়।  

১০। দীর্ঘায়ু পেতে সাহায্য করেঃ
নিয়মিত গ্রিন টি পান করায় প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের ক্ষয় রোধ করে এবং শরীরের জৈবিক বার্ধক্য ধীর করে। এটি হ্রদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিলতা কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে, এর ফলে সুস্থ জীবনকাল বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত গ্রিন টি পান করায় শরীর ও মনের স্বাস্থ্য ভালো থাকে, যা দেহের দীর্ঘায়ু পেতে সাহায্য করে।  

গ্রিন টি পান করার সঠিক  পদ্ধতি 

গ্রিন টি পান করার সঠিক পদ্ধতি মেনে চললে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা সর্বোচ্চ পাওয়া যায়। নিচে ধাপে ধাপে নির্দেশনা দেওয়া হলোঃ
  • পানি গরম করা - গরম পানি (৭০-৮০) সেলসিয়াসে রেখে ২-৩ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন।
  • পাতার পরিমাণ - ১ কাপ (প্রায় ২০০ মি.লি.) পানির জন্য ১-২ চা চামচ (২-৩ গ্রাম) গ্রিন টি ব্যবহার করুন।
  • ছাঁকানো - পাতাগুলো ছেঁকে নিন এবং চা আলাদা করে নিন, অল্প স্বাদের জন্য চাইলে লেবু, হানি, দারচিনি মিশানো যেতে পারে, তবে খুব বেশি স্বাদের জন্য চিনির ব্যবহার বেশি করা যাবে না।   
  • পান করার সময় - সকালে বা বিকেল বেলা খেতে পারেন। নিয়ম মাফিক খেলে হজমে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। 
  • পরিমাণ - দিনে (২-৩) কাপ গ্রিন টি পর্যাপ্ত, অতিরিক্ত গ্রিন টি খাওয়া হলে ঘুমের সমস্যা, পেট ব্যথা বা রক্তচাপ কমে যাওয়ার সমস্যা হতে পারে। 

শেষ কথা 

পরিশেষে একটা কথা বলতে পারি, গ্রিন টি আমাদের শরীর ও মনের জন্য এক অসাধারণ প্রাকৃতিক পানীয়। নিয়ম মাফিক ও সঠিক পরিমাণে গ্রিন টি পান করলে এটি শরীর কে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে। গ্রিন টি তে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষকে সুরক্ষা দেয়, বার্ধক্যকে কমিয়ে দেয় এবং ত্বককে উজ্জ্বল রাখে। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, শরীর ফিট রাখতে চাই তাদের জন্য গ্রিন টি হতে পারে একটি নিরাপদ সহায়ক। শুধু শারীরিক দিক নয়, মানসিক চাপ কমাতে ও মনকে হাসি খুশি রাখতে গ্রিন টির  ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।      

তবে মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত গ্রিন টি পান করা যাবে না, এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই দিনে ২-৩ কাপের বেশি না খাওয়াই ভালো। গ্রিন টিকে এককথায় বলা যায়-প্রকৃতির এক অমূল্য উপহার, যা সঠিক ভাবে ব্যবহার করলে আপনার দেহ  সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘায়ু পেতে সাহায্য করে। সহজ ভাবে বললে, গ্রিন টি শুধু একটা পানীয় নয়, বরং সুস্থ জীবনের এক বিশ্বস্ত সঙ্গী।  


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

রাফিকা আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url